হুন্ডি কিভাবে কাজ করে ? হুন্ডির ইতিহাস ?


hundi kivabe kaj kore
projuktimela

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থ লেনদেনের এক ব্যবস্থা হলো হুন্ডি ।  সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে কয়েক শতাব্দী ধরে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন চলে আসছে ।


এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে প্রবাসীদের নেটওয়ার্ক এবং একে অপরের প্রতি পারসপারিক আস্থা । 


আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে উৎপত্তি হলেও হুন্ডি ব্যবস্থা  এটি আজও প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর জন্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।


তবে বর্তমানে হুন্ডির সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো এটি সকল দেশে সম্পূর্ণ অবৈধ হিসেবে বিবেচিত ।


সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রবাসীরা সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন হিসেবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের বদলে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়েছে । 


প্রযুক্তি মেলার এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে ।


হুন্ডির ইতিহাস ?

হুন্ডি কিভাবে কাজ করে ?

হুন্ডির পরিমাণ কত ?

হুন্ডির দূর্নীতি ?

হুন্ডির সাথে জড়িত চ্যালেঞ্জগুলো ?


হুন্ডির ইতিহাস ?


অতীতে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ বর্তমানেও হুন্ডি অনেকটাই নিরাপদ তবে বৈধ নয় । 


অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সিল ক্রুট কেন্দ্রীক ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হতো ।

একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ীদের আনাগোনা থাকার কারণে

এখানে ডাকাতিও হতো অনেক বেশি ।


নগদ অর্থ বা মূল্যবান সম্পদ এই অঞ্চল দিয়ে পরিবহন করাটা

খুব বেশি নিরাপদ ছিল না ।  সে কারণে তখন থেকেই হুন্ডির প্রসার ঘটে । 


প্রাচীন ভারতেও হুন্ডির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে তৎকালীন সময়ে ভারতীয় বনিকেরাও ব্যবসাবাণীদের জন্য ব্যাপকহারে হুন্ডি ব্যবহার করত হুন্ডি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ হুন্ড থেকে এসেছে

যার অর্থ সংগ্রহ করা ।


হুন্ডির আরেকটি প্রচলিত নাম হচ্ছে হাওয়ালা । 


হাওয়ালা শব্দটি এসেছে আরবি থেকে হুন্ডি আর হাওয়ালা মূলত একই জিনিস তবে এদের মধ্যে সামান্য কিছু পরিচালনার গত পার্থক্য আছে হুন্ডি এবং হাওয়ালার প্রধান পার্থক্য হলো এদের লেনদেনের ধরণ ।


হুন্ডিতে টাকা একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় সরাসরি পরিবহন করা হয় ।


অন্যদিকে হাওয়ালা ব্যবস্থায় টাকাটা হাওলাদার বা দালালদের একটা বিশাল নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে রিং এবং পুঁজি সমন্বয় করে টাকা স্থান আন্তর্জাতিক করা হয় । শুনতে একটু জটিল মনে হলেও দুটির কাজ আসলে সেইম !


হুন্ডি এবং হাওয়ালারের মাঝে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো হুন্ডি সাধারণত ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হয় । 


অন্যদিকে হাওয়ালা মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশি প্রচলিত ।

মুগল শাসনামলে হুন্ডি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ লেন্দেনের মাধ্যম হিসেবে বিকশিত হয়েছিলো ১৭ শতকে বাংলা অঞ্চল থেকে দিল্লিতে ভূমির আদর্শ পাঠানো হতো কফিল বা গরুর গাড়ি দিয়ে । 


এই পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল এবং অনিরাপদ হওয়ার পাশাপাশি

স্থানীয় অর্থনীতি মুদ্রা সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল ।


সে সময়েই হুন্ডির বাজার বিকশিত হয় । 


শুধু সরকারি কাজেই নয় ব্যবসায়ীরা তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ নিজেদের সাথে পরিবহন করার বদলে হুন্ডির মাধ্যমে

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অর্থ স্থানান্তর করতেন ।


তৎকালীন সময়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীদেরকে বলা হতো সররাজ ।


পুরো উপমহাদেশ জুড়ে সররাষ্ট্রা ছিলেন খুবই বিশ্বস্ত

সে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের ১ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অর্থ স্থানান্তরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থা ছিল হুন্ডি। 


পরবর্তীতে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে হুন্ডি ব্যবস্থার পতন ঘটে

তবে একসময় নিরাপদে অর্থ প্রেরণার জন্য যে হুন্ডি ব্যবস্থার উদ্ভাব হয়েছিল

সেটি এখন অর্থনীতির জন্য অনেক বড় সমস্যা তৈরি করছে।



হুন্ডি কিভাবে কাজ করে ?

ঐতিহ্য গতভাবে দূরবর্তী কোন স্থানে তহবিল নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য হুন্ডিকে বিনিময়ের বিল প্রতিশ্রুতি নোট বা আই ও ইউ হিসেবে ব্যবহার করা হতো আই ও ইউ নথি হলো আই ও ইউ এর সংক্ষিপ্তরূপ যার অর্থ । আমি তোমার কাছে ঋণী


হুন্ডি ব্যবস্থাটি মূলত হুন্ডি দালাল এবং হাওলাদার নামে পরিচিত এজেন্টরা পরিচালনা করে থাকে।


বিদেশ থেকে কেউ টাকা পাঠাতে চাইলে এই ধরনের দালাল বা হাওলাদারের সাথে যোগাযোগ করতে হয় । এরা দেশে থাকা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেয়।


প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় খোলা বাজারের ডলারের দাম বেশি পাওয়া যায় সে কারণে প্রবাসীরা অনেক ক্ষেত্রেই বৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর চেয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোকে বেশি লাভজনক বলে মনে করেন ।

হুন্ডির পরিমাণ কত ?

বর্তমানে হুন্ডির মাধ্যমে কি পরিমাণ টাকা দেশে আসে তার সঠিক হিসেব করাটা মুশকিল

তবে ২ বছর আগে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন দেশের প্রবাসী আই আনুষ্ঠানিক বা অফিসিয়াল চ্যানেলে এসেছে ৫১% এবং হুন্ডিতে এসেছে ৪৯% তার মানে প্রবাসীরা যে পরিমাণ টাকা দেশে পাঠায় তার অধেক আসে রেমিটেন্স হিসেবে 


এবং বাকি অর্ধেকই আসে হুন্ডিতে

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আয়োলও প্রায় ১ দশক আগে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্রে বলেছিল

২০১২ থেকে ১৩ অর্থ বছরে প্রবাসীরা দেশে ১০০০ চারশো ছিচল্লিশ কোটি ডলার পাঠিয়েছিল এটি প্রবাসীদের পাঠানো মোট অর্থের ষাইট থেকে ৭০ শতাংশ ।


এর বাইরেও আরো চারশো তিরিশ থেকে পাঁচশো ৭০ কোটি ডলার এসেছিল হুন্ডির মাধ্যমে ।


সুতরাং দেখা যাচ্ছে বহু আগে থেকেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশের একটি বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়

সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রজনতার যে গণ অব্যথানের সৃষ্টি হয়েছে ।


সেখানে প্রবাসীরাও যোগ দিয়েছেন

প্রবাসীদের অনেকে সরকারকে অসহযোগিতা করার জন্য আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের পরিবর্তে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন 


প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন

জুলাই মাসে এর আগের মাসের তুলনায় ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স কম এসেছে


চলতি বছরের জুন মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ২.৫৪ বিলিয়ন ডলার এরপর জুলাই মাসে রেমিটেন্স এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১.৫৭ বিলিয়ন ডলারে 


সাম্প্রতিক ঘটনা ছাড়াও সরকারের ত্রুটিপূর্ণ নীতির কারণেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হুন্ডির লেনদেন অনেক বেড়ে গেছে 


বিশ্বব্যাংকার বিশ্লেষকরা বলছেন দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারের উপর নানা ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করেছে 


এই বিধিনিষেধের কারণেই পরিস্থিতির উন্নতির বদলে আরও অবনতি ঘটেছে 


ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যখন ব্যাংকে গিয়ে এলসিবা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেন না তখন হুন্ডি তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে 

 হুন্ডির দূর্নীতি

হুন্ডির দূর্নীতি ?

বর্তমান সময়ে হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচার 

সাধারণত ধনী ব্যবসায়ীরা তাদের অর্থ বিদেশে পাচার করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে তারা মূলত ওভার ইনভয়ার্সিং এবং আন্ডার ইনভয়জিং এর মাধ্যমে 

দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেয় ।


যারা ঘুষ, দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরা চালান, বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ উপার্জন করে। 


তারাই সবচেয়ে বেশি হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে 


সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আমলা এমনকি সরকারি চাকরিতে অত্যন্ত ছোটপদে কাজ করা ব্যক্তিরাও বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছে


তাদের এই অবৈধ সম্পদ লুকানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থাই হলো হুন্ডি।


যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান

গ্লোবাল ফিনানশিয়াল ইনটিভিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী 

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত 


বাংলাদেশ থেকে ৪,৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ।


এই হিসেবে প্রতি বছর

গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় এটি আজ থেকে ১০ বছর আগের চিত্র ।


সাম্প্রতিক সময় যে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করার পরিমাণ অনেক বেড়েছে তার বলার অপেক্ষা রাখে না 


হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেই বাংলাদেশী দুর্নীতিবাজরা বিদেশে তাদের সেকেন্ড হোম । বা দ্বিতীয় নিবাস তৈরি করেছে ।


বিদেশে বাংলাদেশী দুর্নীতিবাজদের এসব আবাসন বেগমপাড়া নামে পরিচিত । 


এই আর্টিকেলে প্রচারিত সকল তথ্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট / বই / জার্নাল / ম্যাগাজিন / জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম / প্রামাণ্যচিত্র থেকে সংগৃহীত। 


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

প্রযুক্তি মেলার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ 2

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪